বর্গাচাষের বর্ণনা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: সাফাইয়ে মুয়ামালাত
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)
মাসআলাঃ কেউ তার খালি জমি অন্যকে দিয়ে বললো যে, তুমি এতে চাষ করো, যা ফসল উৎপন্ন হবে তা এই হারে বন্টন করে নেবো-একে ‘মুযারা’আত’ বলে, এটা জায়েয আছে।
মাসআলাঃ এক ব্যক্তি বাগান লাগিয়ে অন্যকে বললো যে, তুমি এ বাগানে পানি দাও এবং এর সেবাযত্ন করো, এক বছর, দু’বছর বা দশ বছর পর্যন্ত, যা ফল হবে অর্ধেক অর্ধেক বা তিন ভাগের দুই ভাগ ও একভাগ করে বন্টন করে নেওয়া হবে-একে ‘মুসাকাত’ বলে, এটাও জায়েয আছে।
মাসআলাঃ এভাবে চুক্তি সম্পাদন সঠিক হওয়ার জন্যে কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যথা-
১. জমি চাষ উপযোগী হওয়া।
২. জমির মালিক ও কৃষক জ্ঞানী ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া।
৩. চাষের মেয়াদকাল উল্লেখ করা।
৪. বীজ জমির মালিক দিবে, নাকি কৃষক তা উল্লেখ করা।
৫. কিসের চাষ হবে তা উল্লেখ করা। যেমন, গম বা যব।
৬. মোট উৎপাদিত ফসলের মধ্যে কৃষকের অংশের পরিমাণ উল্লেখ করা।
৭. জমি খালি করে কৃষককে হস্তান্তর করা।
৮. জমির উৎপন্ন ফসলের মধ্যে কৃষক ও মালিক উভয়ে শরীক থাকা।
৯. জমি ও বীজ একজনের হওয়া এবং গরু, শ্রম ও অন্যান্য বিষয় অপরজনের হওয়া বা শুধু জমি একজনের এবং অবশিষ্ট সবকিছু অন্যজনের হওয়া।
মাসআলাঃ উপরোক্ত শর্তসমূহের কোন একটি পাওয়া না গেলে ’মুযারাআত’ অবৈধ হবে।
মাসআলাঃ অবৈধ ‘মুযারাআতে’র মধ্যে উৎপন্ন সমস্ত ফসল বীজের মালিক পাবে আর অপর ব্যক্তি-সে যদি জমির মালিক হয় তাহলে সে নিয়মমাফিক জমির ভাড়া পাবে, আর যদি সে কৃষক হয় তাহলে সে নিয়মমাফিক পারিশ্রমিক পাবে। তবে উভয়ের ধার্যকৃত পরিমাণের চেয়ে ভাড়া বা পারিশ্রমিকের পরিমাণ অধিক না হতে হবে। অর্থাৎ, যদি অর্ধেক ফসলের চুক্তিতে ‘মুযারাআত’ হয়ে থাকে তাহলে মোট ফসলের অর্ধেকের বেশি দেওয়া হবে না।
মাসআলাঃ ‘মুযারাআতে’র চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উভয় পক্ষের কোন একজন শর্তসমূহ পাওয়ার পরও যদি কাজ করতে অস্বীকার করে তাহলে তার থেকে জোর করে কাজ নেওয়া হবে। তবে যদি বীজওয়ালা অস্বীকার করে তাহলে তার উপর চাপ সৃষ্টি করবে না।
মাসআলাঃ চুক্তি সম্পাদনকারীদের কোন একজন মরে গেলে ‘মুযারাআত’ সম্পূর্ণরুপে বাতিল হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ ‘মুযারাআতে’র নির্দিষ্ট মেয়াদ অতিক্রম করার পরও যদি ফসল না পাকে তাহলে নিয়মানুপাতে কৃষক জমির মালিককে অতিরিক্ত দিনসমূহের জমির ভাড়া দিবে।
মাসআলাঃ কতক জায়গায় নিয়ম আছে যে, বর্গা জমিতে যে শস্য উৎপাদিত হয় তা চুক্তিমাফিক নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয়। কিন্তু পশুকে খাওয়ানোর জন্যে যে অপরিপক্ক ফসল উৎপন্ন হয় তা বন্টন করা হয় না, বরং বিঘা হিসাবে কৃষকের থেকে টাকা নেয়। এটি বাহ্যত ‘মুযারাআতে’র শর্তের বিপরীত বিধায় নাজায়েজ মনে হয়। তবে এ ধরনের ফসলকে প্রথম থেকেই ‘মুযারাআতে’র বাইরে ধরে অর্থাৎ, এমন ধরা হবে যে, এ পশুখাদ্যের ব্যাপারে উভয়ের লক্ষ্য ছিলো জমি ভাড়ায় দেওয়া, মুযারাআত করা নয়-তাই এটা জায়েয মনে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উভয়ের সম্মতি শর্ত।
মাসআলাঃ কতক জমির মালিকের অভ্যাস আছে যে, তারা বর্গার অংশ ছাড়াও চাকর-নকরদের হক হিসাবে কৃষকের অংশ থেকেও কিছু নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যদি মোটের উপর বলে যে, তাদের হক হিসেবে দু’ মণ চার মণ নেবো তাহলে এটা নাজায়েয হবে, আর যদি এভাবে নির্ধারণ করে যে, উদাহরণতঃ প্রতি এক মণ থেকে এক সের নিবে তাহলে তা জায়েয হবে।
মাসআলাঃ কতক লোক ক্ষেতে কি বপন করবে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে না। ফলে পরবর্তীতে ঝগড়া হয় এটা জায়েয নয়। হয় বীজের নাম পরিষ্কার উল্লেখ করবে অথবা সাধারণ অনুমতি দিবে যে, তোমার যা ইচ্ছা বপন করো।
মাসআলাঃ কতক জায়গায় প্রচলন রয়েছে যে, কৃষক জমিতে বীজ বপন করে অন্যের হাতে দিয়ে বলে যে, তুমি এর মধ্যে পরিশ্রম করো এবং এর যত্ন নাও যা কিছু ফসল হবে পরিশ্রমকারী উদাহরণস্বরুপ এক তৃতীয়াংশ পাবে-এটিও ‘মুযারাআতে’র অন্তর্ভূক্ত। যে জায়গায় জমির মূল মালিক এ কাজে বাধা না দেয় সেখানে এরুপ করা জায়েয আছে, অন্যথায় জায়েয নেই।
মাসআলাঃ এ ক্ষেত্রেও উপরোক্ত মাসআলার মতো কতক উৎপন্ন শস্য বন্টন করে দেয়, আর কতক শস্যের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি নগদ টাকা দিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রেও বাহ্যত নাজায়েয হলেও উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী জায়েয হবে।
মাসআলাঃ ভাড়া বা বর্গা চাষের ক্ষেত্রে বারো বছর বা তার চেয়ে কমবেশি সময় জমিকে কাজে লাগিয়ে উত্তরাধিকারের দাবী করা সম্পূর্ণরুপে বাতিল, হারাম, জুলুম ও লুন্ঠন। মালিকের খুশি মনের অনুমতি ছাড়া এর থেকে উপকৃত হওয়া কোনভাবেই জায়েয নয়। এমনটি করলে তার উৎপন্ন শস্য অবৈধ এবং তা খাওয়া হারাম হবে।
মাসআলাঃ ‘মুসাকাত’ তথা বাগানের বর্গাচাষের বিধান সর্বক্ষেত্রে ‘মুযারাআতে’র মতো।
মাসআলাঃ ফলবিশিষ্ট গাছের ফল যদি এমন হয় যে, পানি দিলে এবং যত্ন করলে আরো বড় হবে তাহলে এর ‘মুসাকাত’ তথা বর্গা দেওয়া জায়েয আছে। আর যদি ফলের বৃদ্ধি শেষ হয়ে থাকে তাহলে ‘মুসাকাত’ জায়েয নেই। যেমন কিনা ফসল প্রস্ত্তত হয়ে যাওয়ার পর ‘মুযারাআত’ জায়েয নেই।
মাসআলাঃ ‘মুসাকাতের’ চুক্তি ফাসেদ হয়ে গেলে সব ফল গাছওয়ালার হবে আর পরিশ্রমকারী নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিমাণ মতো পারিশ্রমিক পাবে। যেমন কিনা ‘মুযারাআতে’র মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
Leave a Reply